Friday, August 9, 2019

"আগুনের পরশমণি"র কাজের মেয়ে বিন্তি চরিত্র


কাজের মেয়ে বিন্তির চরিত্রে অভিনয় করতে এল গাজীপুরের মেয়ে পুতুল৷ ভীতু ভীতু ধরনের ছোটখাট মেয়ে। অভিনয়ের দারুণ নেশা। সুযোগ পেলেই গাজীপুর থেকে একা একা রামপুরা টেলিভিশন ভবনে চলে আসে। প্রযোজকদের দরজা খুলে ভয়ে ভয়ে উকি দেয় কেউ যদি দয়া করে কোন নাটকে সুযোগ দেয়৷ বয়স বাড়িয়ে (বেশী বয়স দেখিয়ে) সে এক ফাকে অডিশনও দিয়ে দিল এবং যথারীতি ফেল করল। আমি তখন “কোথাও কেউ নেই” টিভি সিরিয়ালের জন্যে অভিনেতা অভিনেত্রী খুঁজছি। তিনটি মেয়ে দরকার যারা প্রসটিটিউটদের চরিত্র করবে৷ কেউ রাজি হচ্ছে না। একদিন বরকতঊল্লাহ সাহেব আমাকে বললেন, “দেখুন তো এই মেয়েটাকে দিয়ে চলবে? এর নাম পুতুল। গাজীপুরে থাকে।”
আমি এক ঝলকে দেখেই বললাম, “চলবে।” 
মেয়েটি “কোথাও কেউ নেই” ধারাবাহিক নাটকে ঢুকে গেল। তেমন কিছু করতে পারল না। অবশ্য তেমন কিছু করারও ছিল না। আমি এই তিন কন্যাকে হাইলাইট করতে চাইনি।

নাটকের কাজ শেষ হল। মেয়েটিকে আমি ভুলে গেলাম৷ তার সঙ্গে অবারো দেখা হল গাজীপুরে৷ সেখানে কবি নামে একটা ডকুমেন্টারি বানাচ্ছি। গ্রামের ভেতর সেট ফেলে কাজ করছি। একদিন এই মেয়ে আমাদের কাজ দেখতে এল। প্রথম দেখায় চিনতে পারলাম না। শাড়ি পরে ঠোটে লিপস্টিক দিয়ে রাজকন্যা সেজে এসেছে I মাথার সব চুল ছেড়ে দেয়া। চুল নেমে এসেছে হাঁটু পর্যন্ত। আমি চুল দেখে মুগ্ধ। আমি বললাম, “এই মেয়ে তুমি কি তোমার চুলগুলি কেটে কদমছাট করতে রাজি আছ?”
সে অবাক হয়ে বলল, “কেন?”
আমি বললাম, “আগুনের পরশমণি নামে একটা ছবি করছি। সেখানে কাজের মেয়ের একটা চরিত্র আছে। সেই মেয়েটার চুল কদমছাঁট করা। তুমি যদি চুল কদমছাঁট করতে রাজি হও তবে আধাঘণ্টা চিন্তা করে আমাকে জানাও।”
সে আধাঘন্টার মত দীর্ঘ সময় নিল না। দশ মিনিটের মাথায় বলল, “চুল কাটব৷”
-“বেশ, তোমাকে যথা সময়ে খবর দেয়া হবে।”

তাকে যথা সময়ে খবর দেওয়া হল। সে ছুটে এল৷ কিন্তু একটা বড় সমস্যা দেখা দিল৷ দেখা গেল ছবির শুটিং যখন হবে তখন তার এসএসসি পরীক্ষা। আমি তাকে বললাম “পরীক্ষা অনেক বড় ব্যাপার৷ তুমি ভালমত পরীক্ষা দাও। পরে কোন এক সময় আমি তোমাকে সুযোগ দেব।” 
পুতুল কাদো কাদো গলায় বলল, “এসএসসি পরীক্ষা প্রতি বছর এক বার করে আসবে কিন্তু আগুনের পরশমণি তো আর আসবে না।”
আমি কঠিন গলায় বললাম, “আগুনের পরশমণি না এলেও অন্য কিছু আসবে। আমি শিক্ষক মানুষ, পরীক্ষা আমার কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ৷ মন খারাপ করো না। তোমার ভালোর জন্যেই তোমাকে আমি নিচ্ছি না। তুমি ভালোমত পরীক্ষা দাও৷ সাম আদার টাইম।”

পুতুলের এক চাচা কিংবা মামা সঙ্গে এসেছিলেন ৷ তিনি আমাকে বললেন, “স্যার আপনি যদি মেয়েটাকে না করেন তাহলে মনের দুঃখেই মেয়েটা পরীক্ষা দিতে পারবে না। আর যদি নেন তাহলে অভিনয়ের ফাকে ফাকে পরীক্ষা দিয়ে পাশ করে ফেলবে বলে আমার ধারণা।”
আমি তাকে নিলাম ৷
পুতুল আনন্দিত গলায় বলল, “দোকান থেকে চুল কেটে আসি? কতটুকু ছোট করব?”
আমি বললাম, “থাক চুল কাটতে হবে না।”

আমি পুতুলের পরীক্ষার রুটিন দেখে তার শূটিং এর ডেট ফেললাম৷ এমনও হয়েছে পরীক্ষার হলের গেটে তার জন্যে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। পরীক্ষা শেষ হওয়া মাত্র গাড়ি তাকে নিয়ে এসেছে এফডিসি তে। মেয়েটির কঠিন পরিশ্রম বৃথা যায় নি। আগুনের পরশমণিতে অভিনয়ের জন্যে বাংলাদেশ সরকার তাকে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে সম্মানিত করেছেন। আগুনের পরশমণি ছবি যখন জাপানে প্রদর্শিত হল তখন জাপানিজ ফ্রেন্ডশীপ সোসাইটির আমন্ত্রণে সে জাপানে গেল৷ গাজীপুরের দরিদ্র পরিবারের পিতৃহীন বাচ্চা একটি মেয়ের জন্যে এটা কম কি? সে যা করেছে নিজে নিজে করেছে। ”পুতুল, তোমাকে অভিনন্দন। তোমার অভিনয় জীবন মঙ্গলময় ও অর্থবহ হোক এই শুভ কামনা!”

বলতে ভুলে গেছি পুতুল প্রথম বিভাগে খুব ভাল রেজাল্ট করে এসএসসি পাশ করেছিল৷

লিখেছেন ----- হুমায়ূন আহমেদ

শেয়ার করুন

Author:

Etiam at libero iaculis, mollis justo non, blandit augue. Vestibulum sit amet sodales est, a lacinia ex. Suspendisse vel enim sagittis, volutpat sem eget, condimentum sem.