আমার ছাত্রটা রাজশাহী ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজে পড়ে। সন্ধ্যায় পড়াইতে যাই। তার আগে দুইজন টিচার তাকে পড়িয়ে আসে। অনেক হাই ক্লাস ফ্যামিলি।বাসায় ঢুকার আগে কলিংবেল দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়৷ বাহিরে এখন কনকনে শীত। চাবি দেয় দ্বিতীয় তলা হতে। বাসায় ঢুকি।ছাত্র বলে একটু রেস্ট নি। রেস্ট নেওয়ার পর পড়া শুরু হয়। প্রায় দেড় ঘণ্টা বকে যাই। তার ফাঁকে নাস্তা।গণিত আর সাধারণ গণিত পড়াই। পড়িয়ে আবার পড়া দিয়ে আসি। রাত জেগে তিনজন স্যারের কাজ করে। অনেক সময় নাকি দুটা বেজে যায়৷ সকালে উঠে আবার স্কুলে যায়। রিক্সা একটা ফিক্সড করা থাকে। স্কুল হতে ফিরে প্রায় তিনটায়। এসে একটু রেস্ট নিয়ে দুপুরের খাবার খায়। তারপর ঘুমায়৷ঘুম হতে উঠে দেখে স্যার বসে আছে। হাতমুখ ধুয়ে আবার পড়তে বসে। এই আমার ছাত্রের জীবন। মাঝেমধ্যে বাহিরে যাওয়ার সুযোগ হয়ে উঠে পরিবারের সাথে। শপিং করে আসে। সাথে বাহিরের সেরা রেস্টুরেন্টে খেয়ে। দুইদিন আগে ব্লুটুথ ইয়ারফোন কিনেছে। ইয়ারফোনটা পেয়ে সে যে কি খুশি!
আমাকে ফাংশন দেখায়। স্যার,এটা দিয়ে এটা করে!
আফসোস!
আফসোস অনেক বেশী হয় আমার ছাত্রের জন্য....সোনালী কৈশোর জীবন সে কিভাবে কাটিয়ে দিচ্ছে। সবকিছু নিয়মতান্ত্রিক। কোনো স্বাধীনতা নেই। একটু খোলা হাওয়ার গায়ে লাগানোর সুযোগ নেই। চার শিকলে বন্দী বাঘের মত জীবন। সবকিছু আছে.... নেই কৈশোরের আমোদপ্রমোদ !!
আমি যখন এই বয়সে ছিলাম....স্কুল হতে ফিরার সময় এক আঙ্কেল এর বাড়ির উঠানে চলে যেতাম। আমার চেয়ে বয়সে অনেক বড়রা যে জায়গায় খেলতো। ব্যাগ মাটিতে রেখে চলতো ক্রিকেট খেলা। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতো। বাড়ি যাওয়ার কোনো চিন্তা ছিল নাহ। মা চলে আসতো খুঁজতে খুঁজতে প্রতিদিন লাঠি হাতে। কানে ধরতাম আর আসবো নাহ। মার খাইতাম। তবুও ঠিক হতাম নাহ। পরেরদিন ঠিকই আমি উঠানে উপস্থিত খেলার জন্য !
পড়তে বসে মার্বেল গণনা করতাম৷ কয়টা লাভ হয়ছে কিংবা ক্ষতি হয়ছে। লাঠিম খেলার সময় আসলে....দিনে দশ বারোটা লাঠিম বানাইতাম। বাজারে সিগারেট প্যাকেট খুঁজে তাস বানাইতাম। ঐ তাস দিয়ে খেলতাম পাড়ার পোলাপানের সাথে। পলিথনে পাথর মুড়িয়ে ঘুরাইতাম অনেকক্ষণ... তারপর ছেড়ে দিতাম। অনেকদূর চলে যেতো। আবার নিয়ে আসতাম।
আহ!
সোনালী কৈশোর।
কত আনন্দে কেটেছে। ছিল না কোনো ডিপ্রেশন। কোনো আক্ষেপ। কোনো কষ্ট। পড়ার এত চাপ। চার শিকলে বন্দী থাকার কোনো প্রবণতা।
অথচ এখনকার কৈশোর জীবন দেখলে.... খারাপ লাগে।
শুধু খারাপ লাগে....খুবই খারাপ লাগে। বাস্তবিক সব খেলা বাদে তারা জড়িয়ে যাচ্ছে ভার্চুয়াল জগতে। যে জিনিস গুলো সম্বন্ধে পরে জানার কথা ছিল...তারা অনেক আগে সে সব জেনে যাচ্ছে। ছোট বয়সে ঐদিকে ঝুঁকে যাচ্ছে। জীবনটা -কে বিতৃষ্ণা প্রাণের দিকে ঢেলে দিচ্ছে।
সামনে আরো খারাপ হবে। খালি মাঠে উঠবে বড় বড় দালানকোঠা!
নিঃশ্বাস হবে বিষাক্ত !
বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা হবে ক্ষীণ !!
ইচ্ছে হয় প্রতিটা মা বাবাকে বুঝাই।
ছেলের কৈশোর জীবনকে এভাবে নষ্ট করে দিয়েন না৷ তাকে ছেড়ে দিন। মানুষের সাথে মিশতে দিন। খেলতে দিন৷
সে খুশি হবে।সে প্রাণ খুলে হাসতে শিখে যাবে। তার এই হাসির কারণে... আপনি বৃদ্ধ বয়সে দিব্যি হাসতে পারবেন !!
তিন সত্যি!
কোনো কিছু কাউকে খুশি করার জন্য করলে...
উপরে উনি শুধু তা ফিরে দেন না...
তার চেয়ে অনেক বেশী দিবেন আপনাকে !!
বিশ্বাস রাখুন।
তাকে বাঁচতে দিন। সোনালী কৈশোর উপভোগ করতে দিন। জীবন অনেক ছোট। ধন-দৌলত,শিক্ষা...এসব আজ আছে... কাল নেই !
সুন্দর ভাবে বেঁচে থাকলে এসব সবই আসবে... যাবে।
কিন্তু এই যে সময় 'কৈশোর জীবন' তা জীবনে একবারই পাওয়া যায়। তা আর ফিরে আসে না.... কোনোভাবে !
-রিয়াজ উদ্দীন পলাশ
ডিপার্টমেন্ট অব ফিজিক্স, রাজশাহী ইউনিভার্সিটি